গণপূর্ত নীতিমালায় “হলোব্লক” ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত হবে

April 28, 2018 admin 0 Comments

পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন’ সংশোধন করা হচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ধারার পোড়া ইট উৎপাদন বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চলতি বছর থেকে সরকারি কাজে পোড়া ইট ব্যবহার করা হবে না। এই ইটের বিকল্প হিসেবে ‘কংক্রিট ব্লক বা বিকল্প ইট’ ব্যবহার করা হবে। জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সব মন্ত্রণালয় ও সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তরে সরকারি নির্মাণকাজে বিকল্প ইট ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন থেকে সরকারের যে কোনো নির্মাণকাজে বিকল্প হিসেবে ব্লক ইট ব্যবহার করতে হবে। গৃহনির্মাণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এইচবিআরআই) উদ্ভাবিত বিকল্প এই ইট পরিবেশবান্ধব ও অর্থ সাশ্রয়ী। এই ইট ব্যবহারে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা কী ব্যবস্থা নিয়েছে- তা জানতে চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে জানিয়েছে, মন্ত্রণালয়ের বেশিরভাগ কাজ গণপূর্ত বিভাগ করছে। ওই বিভাগকে ব্লক দিয়ে সব কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া গণপূর্ত বিভাগও এরই মধ্যে তালিকায় ১৮টি উপকরণ অন্তর্ভুক্ত করেছে। সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগও দ্রুত তালিকায় ব্লক অন্তর্ভুক্ত করবে।

কংক্রিট ব্লক হচ্ছে বালু বা পাথরের গুঁড়া ও সিমেন্টমিশ্রিত বিকল্পভাবে তৈরি ইট। এইচবিআরআই সূত্রে জানা যায়, পোড়ামাটির ইটের বিকল্প হিসেবে যথাযথ প্রযুক্তিতে তৈরি হচ্ছে ব্লক, থার্মাল ব্লক, ইন্টারলকিং ব্লক ও কমপ্রেসড স্টাবিলাইজড আর্থ ব্লক। এসব ব্লক দেশের বিভিন্ন এলাকায় সীমিত পরিসরে তৈরি শুরু হয়েছে। পরীক্ষামূলক যশোরের কপোতাক্ষ নদের বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার করে ব্লক তৈরি করা হচ্ছে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন নদীর বালু দিয়ে ব্লক ইট তৈরি হলে বাঁচবে কৃষিজমি; বন্ধ হবে পরিবেশদূষণ। ইটের চেয়ে ব্লকে ওজন কম হওয়ায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কম। সহজ প্রযুক্তি ও স্বল্প শ্রমে এটা তৈরি করা যায়। এই ইট শব্দ ও তাপ নিরোধক, পরিবেশবান্ধব, ভূমিকম্প সহনীয় ও ব্যয় সাশ্রয়ী। ফলে এ ব্লক ব্যবহারে উদ্যোগ নিয়েছে এইচবিআরআই।

এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, গণপূর্ত বিভাগের সব কাজে ব্লক ব্যবহার করা হবে। এ বছর থেকে সরকারি কাজে ব্লক ছাড়া পোড়া ইট ব্যবহার করা হবে না। কয়েক ধাপে ব্লকের ব্যবহার শুরু করে ২০২০ সালের মধ্যে পোড়া ইটের ব্যবহার বন্ধ করা হবে। তিনি বলেন, ব্লক ব্যবহারে সবাইকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক ভবন ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ব্লকের ব্যবহার বৃদ্ধিতে এখন চাহিদা বাড়ছে। এ জন্য চাহিদা মেটাতে ইটভাটা মালিকদের পোড়ামাটির ইট উৎপাদন বন্ধ করে বিকল্প ব্লক উৎপাদনে যাওয়ার আহ্বান জানান মন্ত্রী।

গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, পোড়া ইট তৈরিতে কৃষিজমি শেষ হচ্ছে। জমির ওপরের উর্বর মাটি তুলে নেওয়ায় উৎপাদন কমে যাচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষা এবং জমি বাঁচাতে ব্লক ব্যবহারে সবাইকে বাধ্যবাধকতার আওতায় আনা হবে।

জানা গেছে, প্রতিবছর দেশে আড়াই হাজার কোটি পোড়ামাটির ইট তৈরি হয়। এতে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টন মাটি ব্যবহার করতে তিন হাজার ৮০০ হেক্টর জমি হারাতে হচ্ছে। এই মাটির তৈরি ইট পোড়াতে ৫০ লাখ টন কয়লা, ৩০ লাখ টন কাঠসহ বিভিন্ন জ্বালানি ব্যবহার হচ্ছে। এই ইটভাটা থেকে দুই কোটি টন কার্বন নির্গত হচ্ছে। এ হিসাবে দেশে নির্গত মোট কার্বনের ২০ শতাংশ ইটভাটা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে। দেশে ইটের যে চাহিদা রয়েছে, তা পূরণে ৩০০ কোটি ব্লকের প্রয়োজন হবে। পাঁচটি ইটের চাহিদা একটি ব্লকে মিটছে। একটি ব্লকে ৩৫ টাকা ব্যয় হয়। বর্তমানে প্রতিটি ইটের দাম ১২ টাকা। পোড়া ইটের চেয়ে ব্লকে উৎপাদন ব্যয় ৪০ শতাংশ কম হয়।

দেশে বর্তমানে ১৬টি ব্লক কারখানায় ব্লক উৎপাদন হচ্ছে। এরই মধ্যে বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস ও গ্রিন ভিস্তা রিয়েল এস্টেটসহ কয়েকটি আবাসন কোম্পানি পোড়া ইট বন্ধ করে ব্লক ব্যবহার করে ভবন তৈরি করছে। পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ৪৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। ৪০০ পরিবারকে এক একর জায়গায় এক ভবনে নিয়ে আসবে। সেখানে সব ভবনে ব্লক ব্যবহার হবে। এই প্রকল্পে ব্লক উৎপাদন করে সরাসরি ব্যবহারের পরিকল্পনা আছে।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন সমকালকে বলেন, ব্লক পরিবেশবান্ধব ও কৃষিবান্ধব। এটা সবুজ প্রযুক্তিতে তৈরি ও জ্বালানি সাশ্রয়ী। এই বিকল্প ইট ভূমিকম্প সহনীয়। নদীর মানসম্মত বালু ব্যবহার করে সহজে স্বল্প ব্যয়ে উৎপাদন সম্ভব হবে। এতে কৃষিজমি রক্ষা হবে। ইটভাটার কার্বন দূষণ বন্ধ হবে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন’ সংশোধনের জন্য খসড়া করা হয়েছে। এখন আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে খসড়া চূড়ান্ত করা হবে।

এইচবিআরআইর পরিচালক (সিইও) মোহাম্মদ আবু সাদেক সমকালকে বলেন, ব্লক দিয়ে এখন বিশ্বের সব দেশে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। তিনি জানান, ৫০ বছর আগে চীন পোড়ামাটির ইট উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে। ব্লকের ব্যবহার বাড়াতে এরই মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে এইচবিআরআই।

আবু সাদেক বলেন, দেশের চাহিদা অনুযায়ী সারাদেশে ২৫০টি ইটভাটা প্রয়োজন। কিন্তু দেশে এক হাজারের বেশি ইটভাটা রয়েছে। আগামী তিন বছরে এগুলো বন্ধ করা হলে ২০ শতাংশ দূষণ কমবে। ইটভাটাগুলোকে প্রথম বছরে ২০ শতাংশ ব্লক উৎপাদন করতে হবে। পরের বছর ৫০ শতাংশ। পরবর্তী বছরে সম্পূর্ণভাবে ব্লক উৎপাদনে যেতে হবে।

বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার ৬০০ কোটি ইট ব্যবহার হয়। সংগঠনের সভাপতি মো. আবু বক্কর সমকালকে বলেন, পোড়া ইট বন্ধ হোক। ব্লকের চাহিদা তৈরি হবে। সারাদেশের ইটভাটা মালিকরা ব্লক উৎপাদন করবেন। আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাবের নেতারাও ব্লক ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আবু বক্কর আরও বলেন, মন্ত্রণালয় তাদের আশ্বাস দিয়েছে, শিগগিরই আইন সংশোধন করে পোড়া ইট বাদ দিয়ে ব্লক ব্যবহারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ব্লক তৈরির জন্য অ্যাসোসিয়েশন থেকে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে পরিবেশ অধিদপ্তর ও ভারতের ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন প্রযুক্তি সহায়তা দিয়েছে। ছোট কারখানা করে ব্লক উৎপাদন শুরু করা হয়েছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও অক্সফাম বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ব্যবস্থাপক খালিদ হোসাইন সমকালকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্লক উৎপাদন হচ্ছে না। প্রয়োজনে ব্লক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে। খালিদ হোসাইন বলেন, বর্তমানে জমির ওপরের উর্বর মাটি কেটে পোড়ানো হচ্ছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

 

চ্যানেল ২৪ এর এই প্রতিবেদন টি দেখুন

 

এছাড়াও বাংলাদেশের অনেক বড় বড় পত্রিকা এই বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করেছে। সেগুলোর কিছু পেপার কাটিং নিম্নে দেয়া হল।

 

Leave a Reply