মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির দিন শেষ
মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন’ সংশোধন করা হচ্ছে। সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে প্রচলিত ধারার ইট তৈরি বন্ধ করা। চলতি বছর থেকে সরকারি কাজে পোড়া ইট ব্যবহার করা হবে না। এই ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিট ব্লক বা ‘বিকল্প ইট’ ব্যবহার করা হবে। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সব মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সরকারি নির্মাণ কাজে বিকল্প ইট ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন থেকে সরকারের যেকোন নির্মাণ কাজে বিকল্প হিসেবে ‘ব্লক ইট’ ব্যবহার করতে হবে। গৃহনির্মাণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত বিকল্প এই ইট পরিবেশ বান্ধব ও অর্থ সাশ্রয়ী। সরকারি নির্মাণ কাজে এই ইট ব্যবহার করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সরাসরি তদারকি করা হচ্ছে।
মাটি দিয়ে ইট তৈরিই হচ্ছে আমাদের দেশের চিরাচরিত প্রথা। ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে তৈরি হয় ইট। আর জমির এই উপরি ভাগের উর্বর মাটি কেটে নেওয়ায় জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কমছে ফসল উৎপাদন। অপরদিকে ইটভাটায় ইট পোড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। ফলে উজাড় হচ্ছে বৃক্ষ সম্পদ। পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এছাড়া, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করায় ইট ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সরকার দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ সম্মত পদ্ধতিতে ইট পোড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে আসছে। কিন্তু কেউ মানছে না এই নির্দেশনা। সর্বোপরি প্রচলিত সনাতন পদ্ধতিতে ইট তৈরি বন্ধ করে বিকল্প কংক্রিট ব্লক তৈরির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
কংক্রিট ব্লক হচ্ছে বালু বা পাথরের গুঁড়া ও সিমেন্ট মিশ্রিত বিকল্পভাবে তৈরি ইট। জানা গেছে, পোড়ামাটির বিকল্প হিসেবে যথাযথ প্রযুক্তিতে তৈরি হচ্ছে ব্লক, থার্মাল ব্লক, ইন্টারলকিং ব্লক ও কমপ্রেসড স্ট্যাবিলাইজড আর্থ ব্লক। এসব ব্লক দেশের বিভিন্ন এলাকায় সীমিত পরিসরে তৈরি শুরু হয়েছে। বিশেষ করে নদীর বালু ও সিমেন্ট দিয়ে ব্লক তৈরি করা যায়। এতে কৃষি জমি রক্ষা পাবে এবং বন্ধ হবে পরিবেশ দূষণ। পোড়া মাটির ইটের চেয়ে এই ব্লকের ওজন কম হওয়ায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কম। সহজ প্রযুক্তি, স্বল্প শ্রমে এটি তৈরি করা যায়। এই ইট শব্দ ও তাপ নিরোধক, ব্যয় সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। দেশের ১৬টি কারখানায় বর্তমানে তৈরি হচ্ছে ব্লক। সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে ব্যবহার করা হবে এই ব্লক। কয়েক ধাপে ব্লকের ব্যবহার সম্প্রসারিত করে ২০২০ সালের মধ্যে পোড়ামাটির ইট ব্যবহার বন্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বেসরকারি পর্যায়ে ব্লক ইটের ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হচ্ছে।
প্রতি বছর দেশে কমপক্ষে আড়াই হাজার কোটি পোড়া মাটির ইট তৈরি হচ্ছে। এতে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টন মাটি ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাই প্রতি বছর বিনষ্ট হচ্ছে প্রায় চার হাজার হেক্টর কৃষি জমি। আর এই মাটির তৈরি ইট পোড়াতে ৫০ লাখ টন কয়লা, ৩০ লাখ টন কাঠসহ বিভিন্ন জ্বালানী ব্যবহৃত হচ্ছে। এইসব ইট ভাটা থেকে দুই কোটি টন কার্বন নির্গত হচ্ছে। যা দূষিত করছে বাতাস। সারাদেশের ইটের চাহিদা মেটানোর জন্য বছরে প্রয়োজন হবে তিনশ’ কোটি ব্লকের। কারণ একটি ব্লকে পাঁচটি পোড়া মাটির ইটের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। পোড়ামাটির ব্লকে উৎপাদন ব্যয় ৪০ শতাংশ কম। পোড়ামাটির ইট তৈরি বন্ধ হয়ে গেছে চীনে ৫০ বছর আগে। অথচ আমাদের দেশে এর প্রক্রিয়া সবেমাত্র শুরু হলো। দেরীতে হলেও এই উদ্যোগ সফল করতে দরকার যথাযথ তদারকি। সারাদেশে যে সাত হাজারের বেশি পোড়া মাটির ইট তৈরির ইটভাটা রয়েছে সেগুলোকে ক্রমান্বয়ে ব্লক তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত করতে হবে। প্রয়োজনে ইটভাটা মালিকদের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রণোদনা দেয়া যায়; সেই সঙ্গে দরকার ব্লক তৈরির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা।